শিশুর অন্ধকার ভীতি

শিশুর অন্ধকার ভীতি | শিশুর অন্ধকারে ভয় দূর করার কার্যকরী উপায়

“শিশু” শব্দটির সাথেই মিলে রয়েছে কোমলতা, নমনীয়তা। যারা অত্যন্ত সহজ সরল স্বভাবের হয়ে থাকে। বাচ্চা শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই যেকোন কিছুতে ভয় পেয়ে যায়। শিশুর অন্ধকারে ভয় পাওয়া ব্যাপারটি খুব একটা অজানা নয়। আমাদের আশেপাশে যেসকল শিশু বেড়ে উঠছে তাদের বেশিরভাগ শিশুরা অন্ধকারে খুব বেশি ভয় পেয়ে থাকে। মূলত অন্ধকারে ভয় পায় না, এমন শিশুর সংখ্যা খুবই কম।

সাধারণত তিন থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে এই অন্ধকার ফোবিয়া দেখা মিলে। তাই আজকে আমরা শিশুর অন্ধকারে ভয় করার কার্যকরী উপায় সমূহ সম্পর্কে আপনাদের সাথে আলোচনা করব। আপনি যদি। শিশুর অন্ধকার ভয়কে দূর করতে চান তাহলে, অবশ্যই আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য যথোপযুক্ত। কেননা আমাদের উল্লেখিত বিষয়গুলি মাথায় রেখে আপনি যদি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাহলে আপনার শিশু অন্ধকার নামক আতঙ্ককে ভয় মনে না করে, তা স্বাভাবিকভাবে নেবে। তাহলে আসুন বিস্তারিত জানি।

আরো পড়ুনঃ কাউকে ভালো লাগলে কি করা উচিত | ভালোবাসা প্রকাশের উপায়

শিশুর অন্ধকার ভীতি

শিশুর অন্ধকার ভীতি মূলত নানা কারণে হতে পারে। যেহেতু বাচ্চারা খুব সহজে যে কোন বিষয়কে ভয় পায় তাই আপনি যদি তার সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলেন, কোন কারনে তাকে বকাঝকা করেন তাহলে সেটাও এক পর্যায়ে গিয়ে অন্ধকার ফোবিয়াতে পরিণত হতে পারে। কেননা সে যখন রাতের বেলা ঘুমায় তখন সেই বিষয়গুলো সর্বদা তার মাথায় কাজ করবে এবং সেটা থেকেই তার ভয়ের উদ্ভব ঘটবে। মূলত একটা শিশু ছোটবেলায় বিভিন্ন ধরনের ভয় পেয়ে থাকে। আর এটা মা অথবা বাবা হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে সক্ষম হবেন। 

শিশুদের মনের এই অন্ধকার ভয় দূর করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তবে এই ভীতিটা শিশুদের জন্য খুবই ভয়ংকর। কেননা একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে– মানুষ সাধারণত অন্ধকারের সবচাইতে ভালো ঘুমাতে পারে। কেননা অন্ধকার মানুষের ইন্দ্রিয় গুলোকে নিষ্ক্রিয় করে মস্তিষ্ককে রাখে শান্ত। আর তাই স্বাভাবিকভাবে শিশুরা যদি অন্ধকারে ভয় পায় তাহলে এটা তাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ যে করেই হোক আপনার শিশুর যদি অন্ধকারে ভয় থেকে থাকে তাহলে সেই ভয়কে দূর করতে হবে। তাহলে চলুন পরবর্তী ধাপে জেনে নেই, শিশুর অন্ধকারে ভয় দূর করার কার্যকরী উপায় সম্পর্কে। 

শিশুর অন্ধকারে ভয় দূর করার কার্যকরী উপায়

শিশুর অন্ধকারে ভয় দূর করার জন্য আমরা আপনাদেরকে এ পর্যায়ে বাছাইকৃত ৮টি টিপস শেয়ার করব। আশা করছি এই টিপস গুলো মেনটেইন করে চলতে পারলে অবশ্যই আপনার শিশুর অন্ধকারের ভয় দূর হবে। সেগুলো হলো:

১. কক্ষে আলো জ্বালিয়ে রাখা

২. শিশুদের পছন্দনীয় খেলনা কিনে দেওয়া

৩. হাতের নাগালে ফোন রাখা

৪. মুভির পেছনের প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত করা

৫. বাস্তবিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধীরে ধীরে বোঝানো

৬. ভয়ের বিষয়বস্তু সমূহের ছবি আঁকতে বলা

৭. কাউন্সিলিং করা

৮. আলো জ্বালিয়ে এবং নিভিয়ে ভয় পরীক্ষা করা।

কক্ষে আলো জ্বালিয়ে রাখা 

যেহেতু আপনার শিশু অন্ধকারকে ভয় পাচ্ছে তাই প্রথমত আপনার কক্ষে আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। শুরুতে আলো জ্বালিয়ে রেখে তার ঘুমের অভ্যাস করতে হবে এবং পরবর্তীতে আপনাকে তার ভয়ের সম্পর্কে অবগত হয়ে ধীরে ধীরে সেটা দূর করতে হবে। তাই আপনার শিশুর মাঝে যদি অন্ধকার ভীতি থেকে থাকে তাহলে, প্রথমত কক্ষের আলো না নিভিয়ে বরং জালিয়ে রাখুন।

শিশুদের পছন্দনীয় খেলনা কিনে দেওয়া

শিশুদের মনের ভয়কে দূর করতে চাইলে তাদের পছন্দমত কাজ করতে হবে আপনাকে। তাই আপনার শিশু কি কি খেলনা পছন্দ করছে সেগুলোর দিকে নজর রেখে তা কিনে দিতে হবে। আর এই সময় বুদ্ধি খাটিয়ে আপনি নিশাচর প্রাণীদের কিছু অদ্ভুত খেলনা পুতুল কিনে দিবেন। যেমন ধরুন বিড়াল, পেঁচা, হনুমান, বাদুড় এবং সেই খেলনার মাধ্যমে তাকে বোঝাবেন যে এগুলো তার বন্ধু। যারা সবসময় তাকে সাহায্য করবে এবং যে কোন বিপদ-আপদে এগিয়ে আসবে। 

আপনার শিশুর যদি অন্ধকারে ভয় পাওয়ার প্রবণতা থেকে থাকে তাহলে সেই মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবে ওই শিশুটি এটা চিন্তা করবে যে, অন্ধকারে যখন সে ভয় পাবে তখন তার বন্ধু হনুমান, পেঁচা, বা তার প্রিয় খেলনা বন্ধুটি তাকে সাহায্য করবে বাঁচাবে। মূলত এই পদ্ধতিটা প্রয়োগ করলেও আপনার শিশুর মাঝের অন্ধকার ভীতি কেটে যাবে ইনশাআল্লাহ। 

হাতের নাগালে ফোন রাখা

শিশুদেরকে ফোন দেওয়াটা উচিত নয় এটা আমরা সবাই জানি। তবে আপনি যদি আপনার শিশুর মাঝে জমে থাকা সেই অন্ধকার ফোবিয়াকে দূর করতে চান তাহলে শিশুর পাশে একটি ফোন অথবা ওয়ারলেস ফোন রাখতে পারেন। যখন আপনার শিশু ভয় পাবে তখন আপনাকে যেন সে ডাকতে পারে। 

আর চেষ্টা করবেন এসময় আপনার সেই শিশুর কাছে থাকার। যদি না থাকেন তাহলে অবশ্যই শোবার ঘরের দরজা খোলা রাখতে ভুলবেন না এবং দরজা একেবারে খোলা ও রাখবেন না। মূলত পর্দার ব্যবস্থা করবেন। 

মুভির পেছনের প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত করা

স্বাভাবিকভাবে একটা শিশু টিভিতে যেসব বিষয়গুলো দেখে থাকে তারা সবটাই সত্যি ভেবে নেয়। তাই আপনাকে চেষ্টা করতে হবে সে টিভিতে যে মুভি বা যে বিষয়গুলো দেখছে সেগুলো সম্পূর্ণ সত্যি নয়, সবটাই প্রযুক্তির খেল। 

যদি আপনি আপনার শিশুর মাথায় এই বিষয়টা বেঁধে দিতে পারেন তাহলে সে যদি টিভিতে তেমন ভয়ঙ্কর কিছু দেখে থাকে তাহলে তার সেই ভয় ভীতিটা কেটে যাবে। 

বাস্তবিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করা

কাল্পনিক এবং বাস্তবতার মাঝে যে তফাৎ রয়েছে সেটা ধীরে ধীরে আপনার বাচ্চাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। আর এটা কিভাবে বোঝাতে হবে একজন বাবা-মা বা অভিভাবক হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই জানবেন। কেননা বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে শিশুদেরকে জানানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, এ সম্পর্কে না জানলে একটা শিশু কখনোই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে না এবং জীবনের সকল পরিস্থিতিকে হ্যান্ডেল করতে পারবে না। 

ভয়ের বিষয়বস্তু সমূহের ছবি আঁকতে বলা

আপনি যদি আপনার শিশুকে তার ভয়ের বিষয়গুলো সম্পর্কে ছবি আঁকতে বলেন এবং পরবর্তীতে সেই ছবিগুলো দেখে তাকে সে সম্পর্কে বোঝান, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শিশুটি আপনার কথা ভালোভাবে বুঝতে পারবে এবং সেটা তার ব্রেন স্কেচ করে ফেলবে। 

তাই চেষ্টা করুন শিশুকে দিয়ে সে সকল ভয় ভীতিকর অন্ধকারে যা যা দেখে ভয় পায় সে সকল বিষয়বস্তুকে ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার। 

কাউন্সিলিং করা এবং আলো জ্বালিয়ে ও নিভিয়ে আপনার শিশুর ভয়কে পরীক্ষা করা 

শিশুর মাঝে অন্ধকার ভয়ের ভীতি দূর করতে তাকে নিয়ে কাউন্সিলিং করুন। তাকে সঙ্গে করে অন্ধকার ঘরে যান এবং তার ভেতরে যে ভয় রয়েছে, সেটা কথার ছলে দূর করার চেষ্টা করুন। 

কেননা সে যদি অন্ধকারকে একবার স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে তাহলে অন্ধকার থেকে যে ভয়টা পেয়ে থাকে সেটা স্বাভাবিকভাবেই হওয়া হয়ে যাবে। আপনার এই টেকনিকগুলো খাটানোর পর পরবর্তীতে নজর দিন যে আপনার শিশু এখনো পর্যন্ত অন্ধকারে আগের মতই ভয় পাচ্ছে কিনা। আর এটা পরীক্ষা করতে কখনো আলো জ্বালিয়ে রাখুন আবার কখনো আলো নিভিয়ে তার ঘুমানোটা পরীক্ষা করুন।

আপনার বাচ্চা যখন অন্ধকারকে জয় করতে শিখবে তখন ইনশাআল্লাহ তার মাঝে থেকে সকল প্রকার ভয় ভীতি কেটে যাবে। তবে হ্যাঁ এ পর্যায়ে আমরা আপনাদেরকে বাচ্চাদের ভয় দূর করার দোয়া, ভয় দূর করার সূরা এবং নবজাতক শিশুরা ঘুমে চমকে উঠলে কি কি করা উচিত সে সম্পর্কে জানাবো। 

বাচ্চাদের ভয় দূর করার দোয়া

রাতে বাচ্চা কান্না করলে কোন সূরা পড়তে হয়? এ সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন বেশ সংখ্যক মুসলিম ভাই ও বোনেরা। তাই এ পর্যায়ে তাদের উদ্দেশ্যে বাচ্চাদের ভয় দূর করার দোয়া আপনাদেরকে অবগত করব। 

পাঠক বন্ধুরা যদি আপনার বাচ্চা হঠাৎ রাতে ভয় পায় এবং ঘুম থেকে চমকে উঠে তাহলে নিম্নলিখিত দোয়াটি পাঠ করুন। 

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ مِنْ غَضَبِهِ وَعِقَابِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ

উচ্চারণ : আউজু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মতি মিন গাদাবিহি ওয়া ইক্বাবিহি ওয়া শাররি ইবাদিহি ওয়া মিন হামাযাতিশ শায়াত্বিনি ওযা আঁই-ইয়াহদুরুন।’

আর যদি আপনার সন্তানের ঘুম না আসে চোখে। তাহলে সে ক্ষেত্রে যে দোয়াটি পাঠ করা সর্বোত্তম হবে সেটা হলো: 

لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ رَبُّ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا الْعَزِيزُ الْغَفَّارُ

উচ্চারণ : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল ওয়াহিদুল কাহহার, রাব্বুস্সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়া মা বাইনাহুমাল আযিযুল গাফফার।’

অর্থ : ‘আল্লাহ ব্যতিত কোনো সত্য উপাস্য নেই; যিনি একক, প্রবল ক্ষমতাশালী; আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং উভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর প্রতিপালক। যিনি পরাক্রমশলী, ক্ষমাশীল।’ (জামে)

ভয় দূর করার সূরা

বাচ্চাদের সমস্যার জন্য প্রাথমিক কিছু সূরা এবং রুকাইয়াহ রয়েছে। তাই আপনার সন্তানের মধ্যে যদি খিটখিটে মেজাজ, হঠাৎ কান্না করার প্রবণতা এবং রাতে ভয় পাওয়ার মত সমস্যাগুলো থেকে থাকে তাহলে এই রুকাইয়া গুলো পাঠ করে সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। রুকাইয়া করার নিয়ম:

  • বাচ্চাদেরকে সামনে বসিয়ে মাথায় হাত রেখে সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সুরা ইখলাস, ফালাক, নাস এগুলো বার বার করে পড়ে পড়ে ফুঁ দেওয়া। এটা মূলত অন্তত ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় ধরে করতে হবে। সাথে নিচের দুটি দোয়া পোড়তে পারেন-

.

أُعِيْذُكُمْ بِكَلِمَاتِ اللّٰهِ التَّامَّةِ ، مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لَامَّةٍ

উচ্চারণ: উঈযুকুম বিকালিমা-তিল্লা-হিত্তাম্মাহ। মিন কুল্লি শাইত্বা-নিন ওয়া হা-ম্মাহ ওয়ামিন কুল্লি ‘আইনিন লা-ম্মাহ।

.

اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ أَذْهِبِ الْبَاسَ، اشْفِهِ وَأَنْتَ الشَّافِي، لاَ شِفَاءَ إِلاَّ شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا

উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা রাব্বান নাস আযহিবিল বা’স । ইশফিহি ওয়া আনতাশ শা-ফী । লা শিফা-আ ইল্লা শিফা-উক। শিফা-আন লা-ইউগা-দিরু সাকামা ।

আবার কখনো কখনো গোসলের পানিতে সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসী আর সূরা ইখলাস, ফালাক নাচ যতবার ইচ্ছা পড়ে ফু দিয়ে ওই পানি দিয়ে গোসল করালেও শিশুদের মাঝে ভয় ভীতি কেটে যায় বলে বিভিন্ন ইমামগণ বলেছেন। ঠিক একইভাবে বাচ্চাদের আপনি যে পানিটা পান করান সেই পানিতে এই সকল দোয়া পাঠ করে ফু দিয়ে খাওয়ালেও মহান আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় দ্রুত ফলাফল পাবেন ইনশাআল্লাহ। 

পরিশেষে: সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা, এই ছিল আমাদের আজকের আলোচনা পর্ব। আশা করছি আমাদের এই আর্টিকেল শিশুর অন্ধকারে ভয় দূর করার কার্যকরী উপায় সম্পর্কে আপনাদেরকে অবগত করতে সক্ষম হয়েছে। আপনাদের মূল্যবান মতামত কমেন্ট করে জানান এবং নিয়মিত এমন সকল পোস্টের নোটিফিকেশন পেতে আমাদের সাথে থাকুন। সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন আল্লাহ হাফেজ।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *