স্কুল ভীতি দূর করার কৌশল
|

স্কুলে যেতে অনীহা? জেনে নিন শিশুর স্কুল ভীতি দূর করার কৌশল।

অল্প বয়সে বাচ্চাদের মধ্যে হঠাৎ করে স্কুলে যাওয়া নিয়ে চরম নেতিবাচক অনুভূতি অথবা ভীতি তৈরি হয়, যাকে স্কুল রিফিউজাল বলে। মূলত একটি শিশুর মাঝে এ ধরনের মনোভাব বা আচরণ দেখা দিলে তা অতি গুরুত্বের সাথে নেওয়া উচিত। আমাদের আশেপাশে বিদ্যালয়ে না যেতে চাওয়া শিশুর সংখ্যা বলা যায় খুবই কম। কেননা শিশুরা স্কুলে সময় কাটাতে অধিক বেশি পছন্দ করে। বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মজার মজার ক্লাস, টিফিন টাইম, খেলাধুলা সবটাই পছন্দ করে একজন বাচ্চা শিশু।

কিন্তু কখনো কখনো শিশুদের মাঝে স্কুল ফোবিয়া দেখা দেয়। তারা একেবারে ই হতে চায় না স্কুল মুখী। এটা কখনো তাদের আচরণে প্রকাশ পায় আবার কখনো কিছু শিশু লুকানোর চেষ্টা করে। আজ আমরা আমাদের এই আলোচনায় আপনাদেরকে সেই সকল শিশুদের স্কুল-ভীতি তৈরি হওয়ার কারণ এবং তা থেকে বের করে নিয়ে আসার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবো। তো সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা, আপনার বাচ্চার যদি স্কুলে যেতে অনীহা থেকে থাকে বা স্কুল ফোবিয়া দেখা দেয় এক্ষেত্রে আপনার করণীয় কি তা জানতে অবশ্যই সম্পূর্ণ আর্টিকেল মনোযোগের সাথে পড়ুন।

আরো পড়ুনঃ শিশুর অন্ধকার ভীতি | শিশুর অন্ধকারে ভয় দূর করার কার্যকরী উপায়

স্কুল ভীতি দূর করার কৌশল

স্কুলভিতে দূর করার জন্য অবশ্যই আপনাকে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। তবে সেই কৌশল বা উপায় সম্পর্কে জানার পূর্বে অবশ্যই স্কুল ভীতির কারণ জানতে হবে, পাশাপাশি আরো ধারণা থাকতে হবে–

  • স্কুল ফোবিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের বৈশিষ্ট্য
  • স্কুল ভীতি জাগরণের কারণ
  • স্কুলভীতি দূর করার কৌশল এবং সমাধানের মাধ্যম।

স্কুল ফোবিয়া কি?

যে সকল শিশুরা স্কুল নামক শব্দটি শুনলে বা স্কুলে যাওয়ার কথা বললেই অস্বাভাবিক আচরণ করে এবং স্কুলে যাওয়াটা যাদের কাছে যন্ত্রণাদায়ক এবং অস্বস্তিকর তাদেরকেই মূলত স্কুল ফোবিয়া শিক্ষার্থী বলা হয়ে থাকে। এক কথায়– অল্প বয়সী ছোট্ট বাচ্চা শিশুদের মধ্যে হঠাৎ করে স্কুলে যাওয়া নিয়ে যে চরম নেতিবাচক অনুভূতি অথবা ভীতির সৃষ্টি হয় তাই হচ্ছে স্কুল ফোবিয়া বা স্কুল রিফিউজাল।

স্কুল ফোবিয়া/স্কুল ভীতির কারণ

বাচ্চা শিশুরা নতুন কোন পরিবেশে গিয়ে যদি সেটা তাদের মনের মত হয় তাহলে অবশ্যই আনন্দ অনুভব করে। ঠিক একইভাবে যদি তাদের কাছে সেটা অপছন্দের বা কষ্টদায়ক মনে হয় তাহলে তাদের মাঝে আনন্দের চাইতে ভয়-ভীতি কঠোরভাবে বাসা বাধে। যে সকল শিশুরা স্কুলে যেতে ভয় পায় যারা, স্কুলের নাম শুনলেই কেঁদে ওঠে, এদিক-সেদিক লুকিয়ে চুরিয়ে বাঁচে তাদেরকে স্কুল ফোবিয়ায় আক্রান্ত শিশু বলা হয়।

মূলত একজন শিশুর মাঝে স্কুল ভীতি তৈরি হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তবে সচরাচর শিশুর স্কুল ভীতি হওয়ার পেছনে দুটি কারণ কে বেশি চিহ্নিত করা হয়। যথা:

  1. মা ও ঘর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ভয়।
  2. স্কুলের সত্যি কোন ভীতিকর পরিবেশ এর আতঙ্ক।

তাই যদি কখনো আপনার শিশুর মাঝে স্কুল যাওয়ার ভীতি দেখতে পান তাহলে অবশ্যই তা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করুন। মনে রাখবেন– কখনো কখনো এই দুইটি বিষয় একসঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে। একটা শিশু স্বাভাবিকভাবে তার পরিবার এবং বাবা-মাকে ছেড়ে থাকার কথা চিন্তা করতে পারেনা। 

সাধারণত ১১ বছরের কম বয়সী শিশুদের মাঝেই এমন আচরণ পরিলক্ষিত হয়। আর এটা মূলত শিশুর কোন অসুখ বা পরিবারে ঘটে যাওয়া কোন মৃত্যুভীতি থেকেও সঞ্চালিত হতে পারে। আবার হয়তো সেই শিশু বাড়িতে থাকাকালীন এমন একজনের সাথে সময় কাটায়, যার কাছে থাকতেই তার অধিক বেশি ভালো লাগে এবং সে ভালো অনুভব করে ও স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। তাই সে যদি তাকে ছেড়ে বিদ্যালয়ে যায় তাহলে তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটবে এটাও তার সেই ছোট্ট ব্রেন ধরে ফেলে তার মাঝে ইস্কুল ভীতির সৃষ্টি করতে পারে। 

তবে এর বাইরেও স্কুল ফোবিয়ার কারণ হিসেবে আরো যে সকল বিষয়কে তুলে ধরা যায় সেগুলো হলো: 

✓ শিশুর জীবনে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন

একটা বাচ্চা শিশুর জীবনে যদি হঠাৎ কোনো পরিবর্তন আসে তাহলে তার মাঝে স্কুল ভীতি তৈরি হতে পারে। পরিবর্তনগুলো হয়তো আপনার কাছে স্বাভাবিক মনে হতে পারে কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না সে একটা শিশু এবং আপনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক স্বাভাবিক মানুষ। তাই সবসময় শিশুদের কে নিয়ে অন্যভাবে তাদের মত হয়ে ভাবার চেষ্টা করবেন। শিশুর জীবনে হঠাৎ কোন পরিবর্তন এলে তার মাঝে স্কুল-ভীতি তৈরি হতে পারে এটা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। 

এখন কথা হলো, কেমন ধরনের পরিবর্তন একটা শিশুর মাঝে স্কুল ভীতি তৈরি করে? সেটা জানতে নিচের পয়েন্ট গুলো মনোযোগের সাথে পড়ুন। কেননা শিশুর জীবনে মূলত এই সকল পরিবর্তন ঘটলে তার মাঝে স্কুল ফোবিয়া দেখা দেয়। যথা:

  • হঠাৎ স্কুল জীবনে পা রাখা।
  • বাবা মাকে ছেড়ে স্কুলে থাকতে হবে এমন নিয়ম তার মাথায় গেঁথে দেওয়া।
  • কোন পোষা প্রাণীর হঠাৎ মৃত্যু ঘটা বা পরিবারের কারো মৃত্যু নিজ চোখে দেখা।
  • বাবা মায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব কলহ বা বিবাহ বিচ্ছেদের মত ব্যাপার স্বচক্ষে দেখা।

এক কথায় একটা শিশুর জীবনে যদি হঠাৎ করে কোনো পরিবর্তন আসে যেটা তার ব্রেন স্ক্র্যাচ করতে পারছে না তখনই মূলত তার মাঝে স্কুল ভিত্তির সঞ্চার ঘটে। 

✓ নতুন পরিবেশ মানিয়ে নেওয়ার চিন্তা

একটা শিশুকে যখন স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয় তখন সেই স্কুল তার কাছে সম্পূর্ণই অপরিচিত একটা জায়গা। সেই সাথে সেখানে অবস্থানরত প্রত্যেকটি শিক্ষক বন্ধু-বান্ধব প্রত্যেকেই তার কাছে অপরিচিত। তাই প্রথম প্রথম নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার চিন্তার কারণেও সেই শিশুটি স্কুলে যেতে না চাইতেই পারে। pmeat gov bd

আমাদের মাঝে কিছু বাবা-মা রয়েছে যারা শিশুদের প্রথম দিকের এই আচরণগুলো স্বাভাবিকভাবে না নিয়ে, তাদের ওপর জোর জবরদস্তি করতে থাকে। আর এটা তাদের কাছে আরও ভীতিকর হয়ে ওঠে। তাই প্রথমত একটা শিশুকে নতুন কোন স্কুলে ভর্তি করানোর পর সেই পরিবেশ সম্পর্কে জানতে সাহায্য করুন এবং যতদিন না পর্যন্ত সবাইকে নিজের মতো করে চিনছে ততদিন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। কেননা নতুন পরিবেশ মানিয়ে নেওয়ার চিন্তা থেকেও স্কুল ফোবিয়া হয়ে থাকে।

অজানা কোন আশঙ্কা

বর্তমান সময়ে এমন অনেক ধরনের ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যেগুলো সম্পর্কে আপনার নিশ্চয়ই জানা থাকবে। কেননা বর্তমান সময়টা যেমন আধুনিক হয়েছে ঠিক একইভাবে আমাদের সমাজে সেই সকল কুরুচিপূর্ণমানুষের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে । যারা তাদের কালো টাকার ব্যবসা সেই সাথে নিজের কার্য হাসিল করতে শিশুদের কেউ ছাড় দেয় না। 

তাই কখনো কখনো এমন কিছু কারণ শিশুর মনে স্কুল ভিত্তির সঞ্চার করতে পারে। তবে কারণ যেটাই হয়ে থাকুক না কেন বাবা-মা বা একজন অভিভাবক হিসেবে আপনাকে মূলত আপনার শিশুর খেয়াল রাখতে হবে এবং তার স্কুলের না যাবার কারণ সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। 

শিশুর পরীক্ষা ভীতি দূর করার কৌশল

শিশুদের মাঝে স্কুলে না যাওয়ার প্রবণতা মূলত পরীক্ষার ভয় থেকেও দেখা দিতে পারে। কেননা স্বাভাবিকভাবে পরীক্ষা এলেই শিশুরা অনেক বেশি ভয় পায় এবং তাদের মাঝে অতিরিক্ত উদ্বেগ কাজ করে। কিন্তু এইচ সিচুয়েশনে যদি আপনি নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু কৌশল অবলম্বন করেন তাহলে আপনি আপনার শিশুর পরীক্ষা ভীতি দূর করতে পারবেন খুব সহজেই। তাহলে আসুন এ পর্যায়ে জেনে নেই শিশুর পরীক্ষা ভীতি দূর করার উপায় বা কলাকৌশল সম্পর্কে। 

১. শিশুকে সময় দিন: শিশুর মাঝে যদি পরীক্ষার ভিত্তির সংসার ঘটে তাহলে তাকে এক্সট্রা সময় দিন। তার মাছের ভয় দূর করুন এবং মাথা ঠান্ডা করে তাকে বুঝিয়ে পড়ান। কখনোই কোন কারনেই শিশুর উপর অতিরিক্ত রেখে যাবেন না। 

২. পড়ার প্ল্যান তৈরি করুন: খুবই সহজ একটা প্ল্যান তৈরি করতে সাহায্য করুন আপনার শিশুকে। তার কোন কোন বিষয়ে খুবই অল্প পড়া রয়েছে তার সম্পর্কে তার কাছ থেকে গল্পের ছলে ভালোভাবে জেনে নিন এবং সে যেন পড়াগুলো মনে রাখতে পারে তা গল্প আকারে বা মজার সাথে তাকে বুঝিয়ে পড়ান।

৩. অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্তি দান করুন: আমরা কিছু অভিভাবক রয়েছি যারা কিনা ভালো রেজাল্ট পাওয়ার আশায় বাচ্চাদের সাথে বেশ ক্ষিপ্ত মেজাজে কথা বলে, যেটা তাদের কাছে উপকারের চাইতে অপকার হিসেবেই বেশি প্রাধান্য পায়। ফলে তাদের মাঝে স্কুল ভীতি তৈরি হয় এবং একদমই স্কুল থেকে দূরে থাকার মনোভাব তৈরি হয়ে যায়। তাই অতিরিক্ত চাপ থেকে শিশুকে মুক্তি দান করে আনন্দের সাথে পড়ান।

৪. সব সময় ইতিবাচক কথা বলুন

যদি আপনার শিশু পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করে তাহলে অবশ্যই তাকে বকাঝকা না করে পরবর্তী পরীক্ষা নিয়ে ভালো কিছু করার পরামর্শ দিন। কেননা আপনার ইতিবাচক কথা তাকে ভালো কিছু বুঝতে সাহায্য করবে এবং নেতিবাচক কথা তার মাঝে ভয়ের সঞ্চার ঘটাবে। 

৫. সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে যান

পরীক্ষা নিয়ে বাচ্চারা স্বাভাবিকভাবে অনেকটা ভয় ভয় থাকে তাই সময় করে আপনি সেদিন সঙ্গে যাবার চেষ্টা করুন। এতে করে অনেকটাই ভালো অনুভব করবে আপনার শিশু এবং তার মাঝে থেকে স্কুল ভীতি কেটে যাবে। 

শিশুর স্কুল ভীতি দূর করতে করণীয়

একটি শিশুর যদি স্কুল ভীতি থেকে থাকে তাহলে প্রথমত তার বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। কেননা একটা বাচ্চার স্কুল কে নিয়ে যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে সেটা শুধুমাত্র তার বাবা-মা ভালোভাবে বুঝতে পারবে এবং তাকে ইতিবাচক বিষয়টা ঠিকঠাক ভাবে বোঝাতে পারবে। সেই সাথে আরো যা যা করনীয় শিশুর স্কুলভীতি দূর করার জন্য সেগুলো হলো: 

  • শিশুর মাঝে কোন মানসিক দুশ্চিন্তা থাকলে সেটা সম্পর্কে জানা এবং তার সেই দুশ্চিন্তাকে দূর করা।
  • স্কুলে শিশুর দৈহিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কিনা এ বিষয় তলিয়ে দেখা।
  • বাসায় না থেকে স্কুলে যাওয়া, স্কুল থেকে ফিরে আসা এবং স্কুলের পরিবেশ নিয়ে প্রশংসা সূচক কথাবার্তা শোনানো।
  • শিশুর পরিবার, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং সাইকোলজিস্ট এর যৌথ ব্যবস্থাপনা। 

কেননা যৌথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি শিশুকে খুব সহজেই তার মধ্যে থাকা স্কুল ভীতি দূর করা সম্ভব। 

পরিশেষে: তো পাঠক বন্ধুরা, যদি আপনার শিশুর মাঝে এমন অপ্রীতিকর লক্ষণ প্রকাশ পায় তাহলে খুব ভালোভাবে তা হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করুন এবং আমাদের দেওয়া কৌশল গুলো গ্রহণ করুন। আশা করছি স্কুল ভীতি দূর করার কৌশল গুলো যদি আপনি প্রয়োগ করেন তাহলে আপনার বাচ্চার মাঝে থেকে এই ভয়ংকর আতঙ্ক কেটে যাবে। 

আজ এ পর্যন্তই সবাই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন এবং কমেন্ট করে জানাবেন শিশুর স্কুল ভীতি দূর করার কৌশল সম্পর্কে আপনাদের মতামত। সবাইকে আল্লাহ হাফেজ।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *