রোজা রেখে রক্তদান | রোজা রেখে রক্ত দিলে কি হয়
সামনেই রমজান মাস। রোজার আগমন ঘটতেই মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসছে, অনেকেই জানার আগ্রহ প্রকাশ করছেন– রোজা রেখে রক্ত দিলে রোজা ভঙ্গ হয় কি না? এটা খুবই সাধারণ একটি প্রশ্ন। আর মানুষের মনে এই প্রশ্ন উদ্বেগের ব্যাপারটা খুব একটা অহেতুক নয়।
কেননা রোজা ভঙ্গের কারণ গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, দেহ থেকে রক্ত বেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু কথা হলো, কাউকে বাঁচানোর বা সুস্থ করার উদ্দেশ্যে যদি রক্তদান করা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে কি রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে? এ বিষয়ে আজকে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করব আপনাদেরকে। সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা, আজকের এই আলোচনায় রোজা রেখে রক্তদান, রোজা রেখে রক্ত দিলে কি হয় এ বিষয়ে কুরআন ও হাদিস সুন্নাহ মতে আপনাদেরকে বিস্তারিত জানাবো। তাহলে আসুন শুরু করি।
আরো পড়ুনঃ বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ কোনটি?
রোজা রেখে রক্তদান
রক্তদান একজন রোগীর সেবার অন্তর্ভুক্ত। আর মহান আল্লাহতালা সে সকল মানুষকে অধিক বেশি ভালোবাসেন যারা তার সৃষ্টিকে ভালবাসে এবং সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে ত্যাগ স্বীকার করে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে– কোন ব্যক্তি যদি কোন মানুষের জীবন রক্ষা করে তাহলে সে যেন পুরা মানবজাতিকে রক্ষা করলো। সুবহানাল্লাহ।
আর যেহেতু রক্তদান মানুষের জীবন মরণের একটি বিষয় তাই এটি নিঃসন্দেহে ভালো কাজগুলোর মধ্যে একটি। কেননা সঠিক সময়ে রক্ত দানে বেঁচে যেতে পারে কারো প্রাণ। কুরআন ও হাদিসের মূলত রোজা রেখে রক্তদান করার ক্ষেত্রে কোনো কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। তবে যদি আপনি তেমন পরিস্থিতিতে পড়েন তাহলে রক্ত দিতে পারেন। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজা রেখে শিঙ্গা লাগিয়েছিলেন। আর এই নিয়ে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে– সিঙ্গার মাধ্যমে শরীরের বিষাক্ত রক্ত বের করা হয়। তাই রোজা রেখে নিজের টেস্ট/পরীক্ষার জন্য কিংবা কোন রবিকে দেওয়ার জন্য রক্ত দিলে রোজার ক্ষতি হবে না। সুবহানাল্লাহ।
তবে হ্যাঁ যদি রক্ত দিতে গিয়ে দুর্বল হয়ে যায় সেই ব্যক্তি এবং সে সময় রোজা ভেঙে ফেলার আশঙ্কা তৈরি হলে সেই অবস্থায় রক্ত দেওয়া মাকরূহ হবে। তাই এটা সুনিশ্চিত যে আপনি রোজা রেখেও নিঃসন্দেহে কাউকে তেমন পরিস্থিতিতে পড়লে রক্ত দান করতে পারবেন। আর আপনি যদি একটু ভালোভাবে চিন্তা করেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে মূলত স্বাভাবিক প্রবেশ পথ দিয়ে শরীরের কোন কিছু প্রবেশ করা এবং শরীর থেকে কোন কিছু বের হওয়াকে বোঝানো হয়। আর তাই রক্ত দিলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
রক্ত দান নিয়ে কিছু কথা
সঠিক সময়ে রক্তদান করলে বহু প্রাণ বেঁচে যেতে পারে। আর কাউকে রক্ত দান করা খুবই উত্তম কার্য। একজন মানুষ হিসেবে আমাদের অন্য একটা মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা খুব জরুরী। সব সময় সুখ ভাগাভাগি করতে নয় বরং দুঃখ বিপদ-আপদ সবকিছু ভাগাভাগি করে নেওয়াটাই উত্তম কাজ। আর এতেই মানুষের আসল আনন্দ।
তাই স্বাভাবিকভাবেই রক্ত দান করা সেই সকল ব্যক্তিদেরকে ভালো মনের মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করাই যায়। আমাদের আশেপাশে মূলত এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা রক্তদান করেন না, আবার কিছু মানুষ রয়েছে যারা রক্তের প্রয়োজনের কথা জানতে পেরে ছুটে চলে যান অনেকটা দূরে। এটা মূলত ওই মানুষের দায়িত্ববোধ বা ভালো লাগার ভালো কিছু করার একটা দারুন আগ্রহ।
মূলত একজন মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত কোন প্রাণ বেঁচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সঠিক সময়ে রক্ত দান করা। তাই আসুন আমরা নিয়মিত রক্তদান করে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসি এবং সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকি।
রোজা রেখে রক্ত দেওয়া যাবে কিনা?
রোজা রেখে রক্ত দেওয়া যাবে কিনা এ ব্যাপারে আমরা ইতিমধ্যে আপনাদেরকে জানিয়েছি। যেহেতু রমজান মাস মুসলিমদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস তাই স্বাভাবিকভাবে এই বিষয়টি নিয়ে তারা আতঙ্কে থাকেন। বেশিরভাগ মানুষ চিন্তা করেন রক্তদান করলেই হয়তো তার রোজা ভেঙে যাবে। আর যেহেতু আমরা মুসলিম আর মুসলিম নারী পুরুষের উপর রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে, তো এ বিষয় নিয়ে চিন্তা হওয়াটা অবাস্তব কিছুই নয়।
রোজা রেখে রক্ত দেওয়া যাবে, আর এই নিয়ে চিন্তার কোনই কারণ নেই। আর শুধু তাই নয়। এ নিয়ে নানা তর্ক বিতর্ক হলে মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক ইমাম সাহেব তার এক সাক্ষাৎকারে জানান—
বমি করা, স্বপ্নদোষ এবং শিঙ্গা লাগানো এগুলো মূলত রোজা ভাঙ্গার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। কেননা সিঙ্গার ই আধুনিক প্রক্রিয়া হচ্ছে শরীর থেকে রক্ত বের হওয়া। তাই যদি কোন দুর্ঘটনা ক্রমে আপনার এক্সিডেন্ট হয়ে যায়, হাত পা বা শরীরের কোন অংশ কেটে যায়, আপনার শরীর থেকে অনেকখানি রক্ত বের হয়ে যায় তাহলে এক্ষেত্রে আপনার রোজা ভঙ্গ হবে না।
তবে আপনার সেই কাটা ছেঁড়া জায়গায় যদি আপনি ঔষধ বা মলম ব্যবহার করেন তাহলে সে ক্ষেত্রে আপনার রোজা কিছুটা হালকা হতে পারে। তাই যদি কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েন তাহলে রোজা ভেঙে গিয়েছে এমন চিন্তা করবেন না। আপনি আপনার নিয়াত ঠিক রেখে রোজা রাখুন। আর যদিও ভুলে সেই রোজা ভেঙে ফেলেন তাহলে পরবর্তীতে রোজা কাজা করে নিতে হবে।
রোজা অবস্থায় ইনজেকশন দেওয়া যাবে কি?
রোজা রেখে রক্তদান করলে রোজা ভঙ্গ হবে না। কিন্তু রোজা অবস্থায় ইনজেকশন দেওয়া যাবে কি? এনিও মানুষের মনে নানা প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরে মূলত নেটসের একজন ইমাম তার মতামত প্রদান করেছেন। তার মতে ইসলামিক শিক্ষায় বলা হয়েছে যে– সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শরীরের ভেতরে কিছু প্রবেশ করানো থেকে মুসলমানদের বিরত থাকা উচিত, অর্থাৎ এটাই হচ্ছে রোজা রাখার নিয়ম।
কিন্তু যেহেতু টিকা পেশীতে দেওয়া হয় তা রক্তের শিরায় পৌঁছায় না, এটি পুষ্টিকর কিছুই নয় সুতরাং টিকা নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না। তাই আপনি রমজান মাসে আপনার প্রয়োজনে মূলত যে কোন টিকা অর্থাৎ ইঞ্জেকশন ব্যবহার করতে পারবেন।
কি কি কারনে রোজা ভেঙ্গে যায়
রোজা রেখে রক্তদান, রোজা রেখে রক্ত দিলে রোজা ভঙ্গ হয় কিনা এবং রোজা রেখে ইনজেকশন ব্যবহার করলে সে ক্ষেত্রেও রোজা ভঙ্গ হয় কিনা এ বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যে সুস্পষ্ট সমাধান আপনাদেরকে প্রদান করেছি। আলোচনার এই মুহূর্তে মূলত কি কি কারণে রোজা ভেঙে যায় সেই পয়েন্টগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরব। তাহলে আসুন জেনে নেই রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ:
- ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে রোজা ভঙ্গ হয়
- রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালেও রোজা ভঙ্গ হয়
- রাত অবশিষ্ট আছে মনে করে সুবেহ সাদিকের পর পানাহার করলে রোজা ভঙ্গ হয়
- জোরপূর্বক সহবাস করলেও রোজা ভঙ্গ হয়
- যিহোবা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোন কিছু বের করে খেলে রোজা ভঙ্গ হয়
- অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গেলে ফেললে রোজা ভঙ্গ হয়।
রক্তদান নিয়ে হাদিস
রক্ত মূলত একজন মানুষের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আর যখন কোন অসুস্থ ব্যক্তির জীবননাশের আশঙ্কা দেখা দেয় এবং অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতে তার শরীরে অন্যের রক্ত দেওয়া ব্যতীত বাঁচানোর কোন প্রথা থাকে না তখন রক্ত দিলে কোন প্রকারের অসুবিধা নেই। কেন না এমন মুহূর্তে রক্ত দেওয়া ইসলাম সমর্থ করে। মূলত কোন ব্যক্তির প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে রক্তদান করাকে ইসলাম আরো বেশি উৎসাহ দেয়।
রক্তদান নিয়ে অনেক হাদিস রয়েছে। রক্ত দান করা ভালো কাজ গুলোর মধ্যে একটি। তবে হ্যাঁ, মনে রাখবেন রক্ত বিক্রি করা জায়েজ নয়। তবে যে শর্তের ভিত্তিতে প্রথম সূরতে রক্ত দেওয়া জায়েজ সাব্যস্ত হয়েছে ওই অবস্থায় যদি যথা রক্ত বিনামূল্যে পাওয়া না যায় তখন তার জন্য মূল্য দিয়ে কিনে নেওয়াটা জায়েজ। তবে যে রক্ত দিচ্ছে এবং তার বিনিময়ে টাকা নিচ্ছে তার জন্য সেটা জায়েজ নয়।
আবার স্বামীর রক্ত স্ত্রীর শরীরে এবং স্ত্রীর রক্ত স্বামীর শরীরে প্রবেশ করানো জায়েজ। তারা একে অপরের জন্য অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের মতো। এক্ষেত্রে কোন খারাপ প্রভাব পড়ে না পাশাপাশি অমুসলিমদের রক্ত দান করাও জায়েজ। কেননা মুসলিম এবং অমুসলিমদের রক্তে কোন ভেদাভেদ নেই। তাই যে কেউ যেকোনো ধর্মের যেকোনো বয়সের মানুষকে রক্তদান করতে পারবে।
পরিশেষে: রোজা রেখে রক্তদান সম্পর্কিত আমাদের আজকের আলোচনা পর্বের এখানেই ইতি টানছি। তো সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন আমাদের আজকের আর্টিকেল আপনাদের কাছে কেমন লাগলো এবং নিয়মিত আমাদের ওয়েবসাইটের যেকোনো পোষ্টের নোটিফিকেশন পেতে সাথে থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।