মেথির উপকারিতা ও ব্যবহার
মেথি কি? মেথির ইংরেজি নাম fenugreek। মেথির উপকারিতা এবং মেথির গুনাগুন বলে শেষ করা মুশকিল। মেথি একটি শক্তিশালী ঔষধি গাছ। এবং আমাদের সবার কাছেই মেথি বেশ পরিচিত একটি মসলা। এটি সারা বিশ্বে জন্মে এবং খাওয়া হয় এটি উত্তর আফ্রিকায় এবং ভারতে বেশি জন্মে। এই উদ্ভিদের বীজ ও পাতা রান্নার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় একটি উপাদান।
ভারতে বেশিরভাগ খাবারেই এই মেথির ব্যবহার করা হয়। মেথি শুধু রান্নার কাজে ব্যবহার হয় না ইতিহাসজুড়ে মেথি উদ্ভিদ অনেক অসুস্থতার জন্য প্রাকৃতিক ঔষধ বা প্রতিকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন রোমে গর্ভবতী মহিলাদের প্রসব বেদনার চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হতো। এবং চীনারা পায়ের দুর্বলতা এবং ফোলা ভাবের চিকিৎসায় মেথির ব্যবহার করত। মেথি বীজ এবং শুকনো পাতা মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে মেথিকে শুধু পাচফোড়ন রান্নার বা মসলা হিসেবে চেনে। তাছাড়া মেথি যে চিকিৎসা সৌন্দর্যচর্চায় ব্যবহার করা হয় তা হয়তো বেশিরভাগ মানুষই জানে না।মেথি শুধু রান্না ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মেথির বিভিন্ন স্বাস্থ্য সুবিধা রয়েছে। মেথিতে রয়েছে অনেক প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান এবং এগুলো মেথিকে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট তৈরি করতে সহায়তা করে। মেথিতে রয়েছে কোলিন,বায়োটিন, ভিটামিন এ ভিটামিন বি ও ভিটামিন ডি খনিজ, প্রোটিন এবং ফাইবার। মেথি বীজের গন্ধ ও স্বাদ ম্যাপল সিরাপ এর মত। মেথি উৎপাদনে ভারত প্রথম। তবে দৈনন্দিন জীবনে মেথি অনেক কাজে লাগে।
মেথির ব্যবহার
মেথি অনেক কাজে ব্যবহার করা যায়। রান্নায়, চিকিৎসায়, ত্বক এবং চুলের যত্ন। প্রথমে আপনি মেথি বীজ নেবেন। মেথি যেকোনো মুদি দোকানে পাওয়া যায় মেথি রাতে পানিতে ভিজিয়ে রাখবেন। সেই পানি সকালে খেতে পারবেন কিংবা মেথি চিবিয়ে খেতে পারবেন। মেথি পাউডার, মেথি সাপ্লেমেন্ট পাওয়া যায় বাজারে সেগুলো খেতে পারবেন। তাছাড়া মেথি পেস্ট করে আপনি ত্বকে এবং চুলে লাগাতে পারবেন। বিভিন্ন ভাবে মেথি ব্যবহার করতে পারবেন। আপনি চাইলে মেথি চা খেতে পারবেন মেথির গুঁড়া দিয়ে চা তৈরি করলে মেথি চা।
মেথির উপকারিতা
মেথির বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। মেথি পাউডার, ক্যাপসুল এবং তেল আকারেও বাজারে পাওয়া যায়। মেথির নির্যাস বিভিন্ন প্রসাধনী এবং সাবানে ব্যবহার করা হয়। মেথি চিকিৎসায় দুর্দান্ত এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মেথি ব্যবহারে আমরা কতটা উপকারিতা পাব আসুন বিস্তারিত জেনে নেই।
প্রসব বেদনা উপশম
প্রাচীন রোমে গর্ভবতী মহিলাদের প্রসববেদনা চিকিৎসার জন্য মেথির ব্যবহার করা হতো। মেথির ব্যবহার মহিলাদের প্রসব বেদনা যন্ত্রণা দূর করতে সাহায্য করে। মেথি যেকোনো ব্যথা দূর করতে কার্যকরী ঔষধ।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
একটা সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে মেথি ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। গবেষকরা দেখেছেন মেথি ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা হ্রাস করে। মেথি দিনে অন্তত এক থেকে দু বার খাবারের সাথে খেলে বা মেথির জল অথবা মেথি গুঁড়া ব্যবহার করলে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর প্রস্রাবের শর্করার পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। মেথি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর সত্যিই কার্যকর।
বুকের দুধ বৃদ্ধি
মেথি গুঁড়ো চায়ের সাথে মিশিয়ে মেথি চা পান করলে মহিলাদের বুকের দুধ বৃদ্ধি হয়। স্তন্যদানকারী মহিলাদের বুকের দুধ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মেথির ব্যবহার করা হয়। মেথি ব্যবহারের মাতৃত্বকালীন সময়ে বুকের দুধ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
টেস্টোস্টেরন মাত্রা বৃদ্ধি
মেথি টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধির প্রাকৃতিক উপায় হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেকেই হয়তো জানেন না টেস্টোস্টেরন কি ? টেস্টোস্টেরন হচ্ছে পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের মধ্যে একটি যৌন হরমোন যা যৌন ক্রিয়া কলাপ, শক্তি মাত্রা আরো অনেক কিছু কে প্রভাবিত করতে পারে। আপনার বয়স বাড়ার সাথে সাথে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা স্বাভাবিক ভাবে হ্রাস পায়। এজন্য অবশ্যই আপনি মেথি জল খেতে পারেন । প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খালি পেটে মেথি জল খেতে পারেন মেথি আপনি সারারাত ভিজিয়ে রেখে সেই জল খাবেন। এতে আপনার টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।
হজমে সাহায্য করে
অনেক যুগ আগে থেকেই মেথি ব্যবহৃত হয়েছে হজমের বিভিন্ন সমস্যার চিকিৎসায়। আজকাল বেশিরভাগ মানুষের এসিডিটির সমস্য, বদহজম, পেট ফাঁপা ইত্যাদি সমস্যা লেগে রয়েছে। হজম সংক্রানত যেকোনো সমস্যা দূর করতে মেথি খুব ভালো কাজ করে। আপনি প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মেথির জল খেতে পারেন কিংবা ভিজিয়ে রাখা মেথি চিবিয়ে খেয়ে নিতে পারেন। এতে আপনার হজমের সমস্যা খুব দ্রুত দূর হবে।
মাসিকের ব্যথা দূর করে
ঐতিহ্যগতভাবে ঔষধ পদ্ধতিতে মাসিকের ব্যথা উপশমের জন্য মেথি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গবেষকরা বলেছেন মেথি ব্যবহারের পিরিয়ডের ব্যথা দূর হয়। মাসিকের প্রথম তিন দিন মেথি ক্যাপসুল বা মেথির জল হালকা কুসুম গরম করে খেলে ব্যথা দূর হয় এবং এটি কয়েক মাস নিয়মিত ব্যবহার করলে এই সমস্যা অনেক কম হয়। এই সময় যে মহিলাদের মাথা ব্যথা এবং বমি বমি ভাব হয় তা দূর করতে মেথির জল বা মেথি চা খেলে খুব সহজেই এসব সমস্যা থেকে পরিত্রান পাওয়া যায়। এজন্য অবশ্যই মাসিক হলে আপনি মেথির জল খেতে পারেন।
ওজন কমাতে সাহায্য করে
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মেথি ভেজানো জল খেলে ওজন কমাতে সাহায্য করে এবং মেথি গুঁড়ো দিয়ে মেথি চা পান করলে ক্ষুধা কম হয় এবং খাওয়ার প্রবণতা অনেক কমে যায়। এতে ওজন কমাতে সাহায্য করে মেথিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, প্রোটিন এবং খনিজ পদার্থ থাকার কারণে শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে কাজ করে। এজন্য প্রতিদিন মেথি মেথি চা খেতে পারেন তাহলে অবশ্যই আপনার অতিরিক্ত ওজন দূর হবে। কিন্তু শুধু মেথির জল খেলেই হবে না সাথে আপনাকে প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপ
মেথি উচ্চ রক্তচাপ কমাতে দুর্দান্ত কাজ করে। উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ফলে হার্ট এর অবস্থার বিকাশের ঝুঁকি কমাতে পারে এবং হাঁটা স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে। কারণ মেথিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা হজম করার খুব কঠিন হয়ে পড়ে। উচ্চ রক্তচাপ কমাতে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মেথির জল খেতে পারেন এতে আপনার সমস্যা অনেক কম হবে বলে আশা করা যায়।
উচ্চ কোলেস্টেরল
মেথি উচ্চ কলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মেথি শুধু কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে তা নয় বরং খারাপ কোলেস্টেরল থেকে শরীরের যেসব ক্ষতি হয় সেসব ক্ষয় ক্ষতির হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে। চর্বিযুক্ত খাবার থেকে নির্গত হওয়ার শোষণের মাত্রা কমিয়ে দিতে মেথি সক্ষম হয়।
জ্বর সর্দি কাশি দূর করে
যাদের কিছুদিন পরপর জ্বর সর্দি হয় বা ঠান্ডা লাগে তারা ঘরোয়া চিকিৎসা হিসেবে প্রতিদিন মেথির জল খেতে পারেন কিংবা দিনে দুবার মেথি গুঁড়ো দিয়ে মেথি চা খেতে পারেন। নিয়মিত খেলে উপকার পাবেন এবং এসব সমস্যা থেকে দূরে থাকবেন।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
মেথি ভেজানো জল কোষ্ঠকাঠিন্যের এক জাদুকরি চিকিৎসা বলা যায়। কারণ প্রতিদিন সকালে খালি পেটে যদি আপনি মেথির জল খান কিংবা ভিজানো মেথি চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন তাহলে দেখবেন আপনার এই সমস্যা একেবারে গায়েব হয়ে যাবে। কারণ মেথি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
বাতের ব্যথা দূর করে
মেথি বাতের ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করে। যেকোনো ব্যথা দূর করার জন্য কার্যকরী ঔষধ বলা হয় মেথিকে। যারা বাতের ব্যথার জন্য অস্বস্তিতে পড়েন তারা মেথি জল খেতে পারেন। বাতের ব্যথা কমাতে মেথি দারুন কাজ করে।
ক্ষত নিরাময়
মেথি এমন একটি ওষুধই উপাদান যা ত্বকের ক্ষত রোধ করে। আপনি যদি আপনার খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন মেথি যোগ করেন তাহলে দেখবেন আপনার শরীরের যেকোনো ধরনের ক্ষত খুব দ্রুত নিরাময় হবে।
কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি
প্রতিদিন সকালে যদি আপনি খালি পেটে মেথি জল বা ভিজানো মেথি চিবিয়ে খান তাহলে আপনার স্ট্যামিনা অনেক উন্নত হবে। মেথি এমন এক প্রাকৃতিক ওষুধ যা আপনার কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
অ্যান্টি ক্যান্সার প্রভাব
গবেষণায় দেখা গেছে মেথি ব্যবহারে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম হয়। এজন্য প্রায় বেশিরভাগ রান্নায় মেথির ব্যবহার করা উচিত। আপনি যদি প্রতিদিন আপনার খাদ্য তালিকায় যোগ করেন তাহলে ক্যান্সার হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারেন। বিশেষ করে মহিলারা ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে রক্ষা পাবেন।
অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট
মেথিতে পাব ফ্লাভোনয়েড অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর মতো প্রদাহ বিরোধী যৌগ থাকে অ্যাজমার মত কিছু রোগের লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে। এজন্য আপনি প্রতিদিন মেথি চা খেতে পারেন আপনার অ্যাজমার সমস্যা দূর হবে।
কৃমির সমস্যা দূর করে
যারা কৃমির সমস্যায় ভুগে থাকেন তারা প্রতিদিন মেথি ভেজানো জল খাবেন। এতে পেটের কৃমি দূর হবে এবং কৃমি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
মাইগ্রেন বা মাথাব্যথা
আজকাল প্রায় সবারই কমন সমস্যা হচ্ছে মাইগ্রেন বা মাথা ব্যথার সমস্যা। কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে মেথি চা খেলেই মাইগ্রেনের ব্যথা দূর হয়।
ত্বকের যত্নে মেথি
রূপচর্চায় মেথির কোন তুলনা নেই মেথি ব্যবহারে ত্বকের ব্রণ ভালো হয় ব্রণের দাগ মিশে যায় শুষ্ক ত্বকের সমস্যায় মেথি খুব ভালো কাজ করে। ডার্ক সার্কেল কুচ কানো ভাব সারিয়ে তুলতে মেথি জুড়ি নেই। আপনি রাতে মেথি ভিজিয়ে রেখে সকালে উঠে মেথি পেস্ট করে টকদই লেবুর রস এবং মেথি একসাথে মিশিয়ে মুখে লাগাতে পারেন এবং ২০ মিনিট পরে মুখ ধুয়ে নিতে পারেত। এতে দেখবেন আপনার ত্বকের সকল সমস্যা দূর হবে।
চুলের যত্নে
চুলে মেথির উপকারিতা নানাবিধ। চুলের যেকোন সমস্যায় মেথির ব্যবহার করতে পারেন। চুল পড়া, চুলের খুশকি দূর করে, চুলের আগা ফাটা রোধ করে চুল গজাতে সাহায্য করে এবং আপনি যদি মেথি মেথি ভিজিয়ে রেখে তা পেস্ট করে ডিম লেবুর রস অলিভ অয়েল টক দই এবং মেথি একসাথে মিশিয়ে মাথায় দিতে হবে এবং ৪৫ মিনিট পরে মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ধুয়ে নিবেন। দেখবেন আপনার চুল কতটা উজ্জ্বল এবং মসৃণ হবে।
তবে যাদের শরীরে অনেক ধরনের সমস্যা রয়েছে তারা মেথির ব্যবহার করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। কারণ মেথির যেরকম উপকারিতাও রয়েছে তেমনি আপনার ক্ষেত্রে তার উল্টোটাও হতে পারে। দেখা যাচ্ছে ব্যবহারে আপনার অনেক ধরনের সমস্যা হচ্ছে। এজন্য অবশ্যই আপনার বড় ধরনের কোনো সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এটি ব্যবহার করবেন।
One Comment